হেলথ২৪.কম, ডেস্ক প্রতিবেদন: বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল এবং সম্ভাবনাময় একটি খাত। স্বাধীনতার পর এই শিল্পখাত বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ প্রণয়নের পর থেকে এই শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বর্তমানে বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮% এর বেশি ওষুধ উৎপাদন করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি করছে। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি, এই শিল্প বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বর্তমান অবস্থা, সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হলো।
বর্তমান অবস্থা:
অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ: বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৮% অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে সক্ষম। এর ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের জন্য দেশের মানুষকে আর বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
রপ্তানি বৃদ্ধি: বাংলাদেশের ওষুধ এখন আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের ১৫৭টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ২১৩ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪% বেশি। এই রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: ওষুধ শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
কোম্পানির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য: দেশে ২৫০টিরও বেশি অনুমোদিত ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে অ্যালোপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি ও হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি কোম্পানি বাজারের প্রায় ৮০% চাহিদা পূরণ করে থাকে।
মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা: স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব (পেটেন্ট) ছাড়ের সুবিধা পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ পেটেন্টপ্রাপ্ত যেকোনো ওষুধ জেনেরিক ফর্মে উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারছে, যা এই শিল্পের সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
বাজারের আকার: বাংলাদেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার বর্তমানে প্রায় ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
চ্যালেঞ্জসমূহ:
কাঁচামালের অভাব: বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরতা। উৎপাদিত ওষুধের জন্য প্রায় ৯৮% কাঁচামাল চীন, ভারত, জাপান এবং জার্মানির মতো দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর ফলে রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়ে যায়।
গবেষণার অভাব: ওষুধ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে হলে গবেষণা ও উন্নয়নের (R&D) পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশে এই খাতে পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ এখনও তৈরি হয়নি।
অবকাঠামোগত সমস্যা: এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস) পার্ক স্থাপনসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যাচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই পার্ক প্রকল্পটি এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি।
জাল ও ভেজাল ওষুধ: নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রয় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের জন্য একটি বড় হুমকি। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও এটি সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
শ্রমিক অসন্তোষ: সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কিছু ওষুধ কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সৃষ্ট এই সমস্যা শিল্পের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
রপ্তানি বৃদ্ধি: মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা ব্যবহার করে এবং নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি আরও বৃদ্ধি করতে পারে। ২০২৫ সালের মধ্যে ওষুধ রপ্তানি ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
এপিআই পার্কের সম্ভাবনা: এপিআই পার্ক সম্পূর্ণরূপে চালু হলে দেশেই কাঁচামাল উৎপাদন সম্ভব হবে। এর ফলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে।
বায়োমেডিক্যাল উদ্ভাবন: ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ যেমন- ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের মোকাবিলায় বাংলাদেশ বায়োমেডিক্যাল উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
দক্ষ মানবসম্পদ: ওষুধ শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে আরও গুরুত্ব দেওয়া হলে এই খাতের বিকাশ আরও ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে কাঁচামাল নির্ভরতা, গবেষণার অতথ্যের উৎস: ভাব এবং অবকাঠামোগত সমস্যার মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারলে এই শিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারে। সরকার, শিল্প উদ্যোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিশ্ব বাজারে তার অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে।
বাংলাপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, বণিক বার্তা, যুগান্তর, বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি (BAPI), ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA), ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ বাংলা ট্রিবিউন।